প্রতিবাদের সুতোয় গাঁথা বাংলাদেশ

No Place for RAZAKARS in Bangladesh






ঢাকার শাহবাগ থেকে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। চট্টগ্রামের প্রেসক্লাব চত্বর থেকে রাজশাহীর আলুপট্টি মোড়। খুলনার শিববাড়ি মোড় থেকে বরিশালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। বগুড়ার সাতমাথা থেকে যশোরের চিত্রা মোড়। কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে কুষ্টিয়ার থানা মোড়। এই বাংলাদেশ প্রতিবাদের সুতায় গাঁথা। এই প্রতিবাদ তরুণের, যুবকের, প্রৌঢ়ের। এই প্রতিবাদ ভ্রাতা-ভগ্নি-মায়ের। এই প্রতিবাদ সারা বাংলার।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি আদায়ে শাহবাগ থেকে এর শুরু। চলছে টানা তিন দিন। মাঝে নির্ঘুম টানা দুই রাত। দুই দিনের হরতাল শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। তাতে জমায়েত কমেনি। ভোর থেকে গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে রাজধানীর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ চত্বর। চার রাস্তার মোড়টিকে ঘিরে নতুন প্রজন্ম যেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
সব মতের মানুষের এখন ঠিকানা যেন একটাই—রাজধানীর শাহবাগ চত্বর। কেউ কেউ এর নাম দিয়েছেন প্রজন্ম চত্বর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে চেতনার যে প্রদীপ জ্বেলেছে তারুণ্য, তা অগ্নিশিখা হয়ে ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, সারা দেশে।
একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করেছেন। পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ’৯২-এ শহীদজননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণ-আদালত বসিয়েছিলেন এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে শাহবাগ চত্বরে যুদ্ধাপরাধীদের অসমাপ্ত বিচার সমাপ্ত করার পণ করেছে এই প্রজন্ম।
গতকাল ভোরে সূর্য উদয়ের আলোর মতোই জনতার ঢল ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সময় যত এগিয়েছে, মানুষের ঢল তত বেড়েছে। আর রাতে মশালে মশালে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা শাহবাগ চত্বরকে আরও আলোকিত করে রাখে। সেখানে কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চায় তারা। মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তর সালে যেমন পণ করেছিলেন দেশ স্বাধীন না করে বাড়ি ফিরবেন না, নব প্রজন্মের যোদ্ধারাও ফাঁসির রায় না শুনে শাহবাগের ওই মঞ্চ ছেড়ে যাবেন না—এ কথা ভোর থেকেই জানিয়ে দেন।
শাহবাগ চত্বরের ওই নতুন লড়াইয়ের ময়দানে কোনো বড় নেতা বা দফার ফুলঝুরি নেই। আছে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। স্লোগান, গান, কবিতা, নাটক এখানকার অস্ত্র। যুদ্ধাপরাধীদের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। নতুন প্রজন্মের অগ্নিকন্যাদের গগনবিদারী স্লোগান গুলি আর বোমার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তায় আর দুই পাশের দেয়ালেও চারুকলার শিক্ষার্থীরা তাঁদের চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন তাঁরা। কেউবা বুকে-কপালে কার্টুন আর স্লোগান লিখে প্রতিবাদে যোগ দেন। সকালে তিরন্দাজ নামের একটি নাটকের দল অনৈতিহাসিক নামের একটি নাটক মঞ্চায়ন করে।
আন্দোলনকারীরা জানালেন, এই নতুন লড়াইয়ে বাধা দিতে যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরাধিকার জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাও সক্রিয় থেকেছেন। একাত্তরের মতো এই আন্দোলন দমাতেও তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসা মিছিলগুলোতে বাধা দিয়েছেন। রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগে শিবিরের কর্মীরা মিছিলকারীদের লাঠি নিয়ে ধাওয়া দিয়েছেন। কিন্তু সব বাধা ডিঙিয়ে মিছিল ঠিকই শাহবাগে পৌঁছেছে।
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরামের আল আমীন জানান, এখানে কোনো নেতা বা কর্মী নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যাঁরাই একমত হয়েছেন, তাঁরাই এখানে জড়ো হচ্ছেন। বিদেশ থেকেও এসে অনেকে এখানে জমায়েত হচ্ছেন। ফাঁসির রায় না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা শাহবাগ চত্বর ছেড়ে যাবেন না বলে জানান।
এ আলো ছড়িয়ে গেল: ভোরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারুণ্যের সেই অপ্রতিরোধ্য শক্তির সঙ্গে প্রবীণেরা পাশে থেকেছেন অনুপ্রেরণা দিতে। গায়ে রক্ত লাল পাঞ্জাবি আর লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা কপালে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধারাও ভোরে হাজির হয়েছিলেন। তাঁদের চোখে-মুখেও অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির আকুলতা। স্কুল শেষ করে মায়ের হাত ধরে শিশু, কলেজে ক্লাস শেষে কিশোর-তরুণেরা হাজির হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নবজাগরণের সূতিকাগার শাহবাগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাজধানীর বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাড়া-মহল্লার ক্লাব সংগঠন কেউই বাদ যায়নি। শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী, সংগঠক-কর্মী সবাই এক মিছিলে হাজির। বেলা ১১টার দিকে প্রচ্ছায়া ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন কাদের মোল্লার কুশপুত্তলিকা নিয়ে হাজির হয়। শাহবাগ চত্বরেই তারা সেটি পোড়ানো শুরু করলে আন্দোলনের সংগঠকেরা মাইকে বলে ওঠেন, ‘আমরা জামায়াত-শিবিরের মতো বিশৃঙ্খল-নৈরাজ্যপূর্ণ আচরণ করব না। আমরা সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
সকাল আটটায় মাইকে স্লোগান উঠল, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা; ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’—এই আহ্বানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যোদ্ধারা জড়ো হতে থাকেন। হাতে হাত ধরে প্রজন্ম চত্বরের মূল মঞ্চ ঘিরে বেষ্টনী তৈরি করেন তাঁরা।
মঙ্গলবার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা দেওয়ার রায় ঘোষণার পর বেলা তিনটা থেকে শুরু হয় এই আন্দোলন। গতকালও ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম এবং প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন।
সংহতি: সাবেক সেনাপ্রধান ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, প্রবীণ বামপন্থী নেতা হায়দার আকবর খান রনো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ আরও অনেকে শাহবাগে এসে ফাঁসির দাবির সঙ্গে সংহতি জানান।
সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের চোখে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় দেখতে পেয়েছি। এখন আমি নিশ্চিন্তে ঘাসের নিচে কবরে চলে যেতে পারব।’
হায়দার আকবর খান রনো বলেন, এই ৭০ বছর বয়সেও তিনি তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত লড়াইয়ে থাকবেন। দেশকে রাজাকারমুক্ত না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে তরুণদের পাশে দেশবাসীকে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
আনোয়ার হোসেন বলেন, আরেকটা যুদ্ধের সময় এসেছে। আর এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবে তরুণেরা। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শিবিরমুক্ত দেশ গড়তে হবে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, এক-এগারোর সময় ছাত্র আন্দোলনের ফুটেজ দেখে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করেছিল। জামায়াত-শিবির সারা দেশে যে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তার ফুটেজ দেখে গোয়েন্দাদের এদের গ্রেপ্তার করা উচিত।


source:Prothom alo
Powered by Blogger.